কবি কাজী নজরুল ইসলাম
কবি কাজী নজরুল ইসলাম: বিদ্রোহ ও প্রেমের অনন্য গাঁথুনি
কাজী নজরুল ইসলাম, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক,
নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ এবং দার্শনিক। তিনি একাধারে বিদ্রোহী কবি ও জাতীয় কবি হিসাবে
পরিচিত। নজরুলের কবিতা ও গানগুলোতে যেমন প্রেমের জয়গান ধ্বনিত হয়েছে, তেমনি অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধেও তাঁর কন্ঠ
ছিল সোচ্চার।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন:
২৪ মে ১৮৯৯ সালে (১১ই
জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর পিতার নাম ছিল কাজী ফকির আহমেদ এবং মায়ের নাম ছিল
জাহেদা খাতুন। দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হওয়া নজরুল, ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া।
শিক্ষা ও কর্মজীবন:
নজরুলের প্রথাগত শিক্ষা
বেশিদূর এগোয়নি। তবে তিনি নিজ চেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত,
আরবি ও ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন। ১৯১৭ সালে তিনি ভারতীয়
সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং করাচি যান। সেখানে তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। ১৯২০
সালে কলকাতায় ফিরে এসে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
সাহিত্যিক জীবন:
কাজী নজরুল ইসলামের
সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় কবিতা লেখার মাধ্যমে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ছিল
"মুক্তি"। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত কবিতা
"বিদ্রোহী"। এই কবিতাটি তাঁকে রাতারাতি পরিচিতি এনে দেয় এবং তিনি 'বিদ্রোহী কবি' হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন।
নজরুলের কবিতায় প্রেম, দ্রোহ,
সাম্যবাদ এবং জাতীয়তাবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য
কাব্যগ্রন্থ হলো অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, ভাঙ্গার গান, ছায়ানট, চিত্তনামা, ও সন্ধ্যা।
তিনি শুধু কবিতাতেই
সীমাবদ্ধ ছিলেন না, নজরুল অনেক গানও লিখেছেন এবং সুর দিয়েছেন। তাঁর গানগুলি
"নজরুলগীতি" নামে পরিচিত। "চল্ চল্ চল্" গানটি তাঁর অন্যতম
জনপ্রিয় গান।
সাংবাদিকতা:
নজরুল ছিলেন একজন সাহসী
সাংবাদিক। তিনি 'নবযুগ', 'ধূমকেতু' ও 'লাঙল' পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে তিনি সমাজ ও রাজনীতির
অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে তুলেছেন।
রাজনৈতিক জীবন:
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন
একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ। তিনি অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
শ্রমিক ও কৃষকদের অধিকারের জন্য তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন:
১৯২৪ সালে নজরুল প্রমীলা
দেবীকে বিয়ে করেন। তাঁদের চার সন্তান ছিল। ১৯৪২ সালে তিনি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত
হন এবং দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন।
প্রয়াণ:
২৯ আগস্ট ১৯৭৬ সালে (১২ই
ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) ঢাকায় কাজী নজরুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
কাজী নজরুল ইসলামের অবদান:
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তিনি বাংলা কবিতাকে নতুন পথে
চালিত করেছেন। তাঁর গান ও কবিতা আজও বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে।
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন
কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে একজন দেশপ্রেমী,
সমাজ সংস্কারক এবং মানবতাবাদী। তিনি সর্বদা অন্যায় ও
অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন মনে রাখবে।
Post a Comment